চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সাবেক সচিবের ছেলের ফলাফল জালিয়াতির ঘটনায় ৪ জনের নামে মামলা করেছেন বর্তমান বোর্ড সচিব অধ্যাপক ড. এ কে এম সামছু উদ্দিন। মঙ্গলবার (২১ জানুয়ারি) নগরীর পাঁচলাইশ থানায় এ মামলা করা হয়।
অবশেষে দীর্ঘ দেড়মাস পর জালিয়াতি মামাল ঘটনায় কিবরিয়া মাসুদ নামের এক কর্মকর্তাকে হাজিরা দিতে গিয়ে জেল হাজতে প্রেরণ করেন পুলিশ ।আটকের বিষয়টি নিশ্চিত করেন চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মোহাম্মদ ইলিয়াস।
এদিকে মামলার আসামিরা হলেন- চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের তৎকালীন চেয়ারম্যান (অবসরপ্রাপ্ত) প্রফেসর মুস্তফা কামরুল আখতার, তৎকালীন বোর্ড সচিব নারায়ন চন্দ্র নাথ, সাবেক সিনিয়র সিস্টেম এনালিস্ট কিবরিয়া মাসুদ খান ও ফলাফল জালিয়াতি করা শিক্ষার্থী নক্ষত্র দেবনাথ। মামলার বাদী চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিব এ কে এম সামছু উদ্দিন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এই মামলাটি করার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে আদেশ ছিল। আমরা এতদিন কাদের আসামি করা যায় সেসব রুটিন ওয়ার্ক শেষ করেছি। যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এই মামলা করা হয়েছে।সাবেক চেয়ারম্যান কামরুল আখতারকে আসামির বিষয়ে তিনি বলেন, তৎকালীন চেয়ারম্যান ছিলেন দুষ্টের পালন ও শিষ্টের দমন প্রকৃতির। তিনি যদি ওই সময়ে চেয়ারম্যানসুলভ আচরণ করতেন তাহলে এই ঘটনা এতদূর গড়াতো না। জালিয়াতির অভিযোগ পাওয়ার পর মন্ত্রণালয় থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করতে বলা হলেও তিনি তদন্ত কমিটি গঠন করেননি।’এবিষয়ে জানতে চাইলে বোর্ডের সাবেক সচিব ও ফলাফল জালিয়াতির ঘটনায় নারায়ন চন্দ্র নাথের স্ত্রী বনশ্রী নাথ যার বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন সেই আবদুল আলীম বলেন, ‘প্রফেসর নারায়ন চন্দ্র নাথের ছেলের ফলাফল পুনঃনিরীক্ষণের আবেদন বাতিল চেয়ে তৎকালীন বোর্ড চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করা হয়েছিল। সেই আবেদনে তা নিরীক্ষণ না করার জন্য পরীক্ষা নিয়ন্ত্রককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক চিরকুটের মাধ্যমে তা সিনিয়র সিস্টেম এনালিস্টকে নির্দেশনা দিয়েছিলেন যাতে তা (নক্ষত্র দেবনাথের ফলাফল পুনঃনিরীক্ষণ) না হয়। তখনই যদি পুনঃনিরীক্ষণ করা হতো তাহলে শুরুতেই বিষয়টি সমাধান হয়ে যেত এবং এতদূর পর্যন্ত আসতো না।
অভিযুক্ত চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান মোস্তফা কামরুল আখতার বলেন,‘ আমার কাছে অনেকগুলো কাগজে সাইন করার জন্য আনা হয়েছিল। তখন আমি যেটা যে ডিপার্টমেন্টের সেই ডিপার্টমেন্টের প্রধানদের মার্ক করে দিতাম। এমনই একটি আবেদনে আমি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রককে ব্যবস্থা নিতে বলেছি। পরে জেনেছি ওটা পুনঃনিরীক্ষণ আবেদন বাতিলের। জানার সাথে সাথে আমি ওই আবেদন বাতিল করে দেই। আর তদন্ত কমিটি গঠন করার বিষয়টি আমি অবসরে আসার পর গঠন করতে বলা হয়েছে।’মামলায় আসামি করার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী পরীক্ষার দায়িত্ব পরীক্ষা শাখার এবং পরীক্ষা শাখার অধীনস্থ কম্পিউটার শাখার। এখানে চেয়ারম্যান শুধু অনুমোদনকারী। কিন্তু মামলায় পরীক্ষা শাখার ও কম্পিউটার শাখার লোকদের আসামি করা হয়নি কেন?’প্রসঙ্গত, ২০২৩ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সাবেক সচিব নারায়ণ চন্দ্র নাথ তার ছেলে নক্ষত্র দেবনাথের ফলাফলে জালিয়াতি করে জিপিএ-৫ পাইয়ে দিয়েছেন। এ নিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৫ সেপ্টেম্বর মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের শৃঙ্খলা শাখার সিনিয়র সহকারী সচিব শতরুপা তালুকদার স্বাক্ষরিত অফিস আদেশে নারায়ন চন্দ্র নাথকে ওএসডি করা হয়। একইসাথে তার বিরুদ্ধে এবং ফলাফল জালিয়াতির সাথে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করার নির্দেশনা দেয়া হয় চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যানকে।এ নিয়ে ২০২৩ সালের ৬ ডিসেম্বর দেশ রূপান্তরে ‘সচিবের ছেলের পুনঃনিরীক্ষণ আবেদনের রহস্য’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। এছাড়া গত বছরের ১০ মার্চ ‘পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের চিরকুট ফাঁস’ শীর্ষক প্রতিবেদনও প্রকাশ হয়েছিল দেশ রূপান্তরে। সেই রিপোর্টের পর অন্যান্য মিডিয়ায়ও নারায়ণ চন্দ্র নাথের অনিয়ম নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়ে আসছিল। পরবর্তীতে গঠিত তদন্ত কমিটির কার্যক্রম ও গত ৪ আগস্ট তদন্ত রিপোর্ট জমাদানের পর এই ব্যবস্থা নিয়েছিল মন্ত্রণালয়। প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র নাথে ছেলের ১৩ বিষয়ের মধ্যে ১১ বিষয়ের নৈর্ব্যক্তিক ও সৃজনশীল নম্বরপত্র পরিবর্তন করেছিলেন বলে তদন্ত রিপোর্টে উত্থাপন করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ওএসডি হওয়া প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র নাথের ছেলে নক্ষত্র দেবনাথ ২০২৩ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। শুধু বাংলা বিষয় ছাড়া সব বিষয়ে সে জিপিএ-৫ পায়। কিন্তু চতুর্থ বিষয়ে জিপিএ-৫ পাওয়ায় সামগ্রিক ফলাফল সে জিপিএ-৫ পেয়েছিল। কিন্তু বাংলায় জিপিএ-৫ না পাওয়ায় তার পরিবারের পক্ষ থেকে বোর্ডের নিয়মানুযায়ী পুনঃনিরীক্ষণের আবেদন করতে গেলে দেখতে পান কে বা কারা আগে থেকে সব বিষয়ের জন্য পুনঃনিরীক্ষণের জন্য আবেদন করে রেখেছেন। এতে নিজের সন্তানের জন্য শঙ্কিত হয়ে ছেলের পক্ষে তার মা বনশ্রী নাথ পাঁচলাইশ থানায় ২০২৩ সালের ৪ ডিসেম্বর জিডি করেন।সেই জিডিতে কে পুনঃনিরীক্ষণের জন্য আবেদন করেছেন তা বের করার আবেদন জানানো হয়। পাঁচলাইশ থানা পুলিশ তদন্ত করে দেখতে পায় পুনঃনিরীক্ষণের আবেদনে রেফারেন্স মোবাইল নম্বর দেওয়া হয়েছে বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর আবদুল আলীমের মোবাইল নম্বর। এ ঘটনায় প্রফেসর আবদুল আলীমকে পুলিশ ডেকেছিলও।
তিনি তখন বলেছিলেন, ‘কে বা কারা আমার মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে আবেদন করেছেন আমি জানি না।’ উপরন্তু তিনি এতে প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র নাথকে দায়ী করে পাল্টা আরেকটি জিডি করেছিলেন কোতোয়ালী থানায়। পরবর্তীতে পুলিশ জিডির রিপোর্ট সাবমিট করার পর সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটে মামলা করে বনশ্রী নাথ। আর এতে প্রফেসর আবদুল আলীম ও প্রফেসর মুহম্মদ ইদ্রিস আলীকে আসামি করা হয়।